সেই ছ্যানা আমল থেকেই বেলুন আমার বড্ড ভালো লাগে। বাড়ির পাশে প্রতিবছর চরকের সময় যে মেলাটি বসে, সেখানে বেলুনওলাদের দেখে আমার কিরকম একটা প্রেম পেত ইলাস্টিকের মত। হা পিত্যেস পিচুটি জমা চোখে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতাম ওই ফুলো ফুলো রাবার গুলোর দিকে। বেলুনওলা কি মোক্ষম এক একটা ফুঁ মেরে একটানে টানটান বেলুনগুলো তৈরি করে ফেলত, ভাবলেই ভ্যাবলা হয়ে যেতাম। পরে ওরা অবশ্য কোত্থেকে পাম্প দেবার যন্তর গুলো নিয়ে এল, তা অন্য প্রশ্ন। বিষণ্ণ ব্যাপারটা ছিল, আমায় বেলুন কিনতে দেওয়া হত না কোনো এক অজ্ঞাত কারণে। আর যত না পাওয়া যায় তত পেতে চাওয়াটা আসন গেঁড়ে গুছিয়ে বসে মনের কোণে। কত রকমের বেলুন… গোল বেলুন, লম্বা বেলুন, ব্যাঁকা ব্যাঁকা বেলুন, স্পার্ম বেলুন…
ক্যাপ্টেন ভিয়ম ও আমি -
লোকে প্রচুর সিরিয়াল দেখে, আগেও দেখত। আমিও দেখেছি কিন্তু সেই আমলে কোন একটা শেষ করেছি বলে মনে পড়ছে না একমাত্র ক্যাপ্টেন ভিয়ম ছাড়া। “ভি উম বা… ভি ভি ইউম বা… ক্যাপ্টেন ভিয়ম” বলে একটা গম্ভীর শুরু (ঘোড়াড্ডিম কি বলত আজও বুঝিনি)। হয়তো তার পাঁচ মিনিট আগে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গেছি। কোন রকমে ছুঁচিয়ে এক দৌড়ে বোকাবাক্সের সামনে। সেই বাবল্ এ চড়ে আকাশপথে চুকিৎকিৎ বেজায় ভালো লাগত। ঐ বড় বড় গ্যাস বেলুনের মধ্যে নিজেকে ক্যাপ্টেন জেন হয়ে মিলিন্দ সোমানকে বগলদাবা করে কত বেলাট্রিক্স-সিরিয়াস করেছি তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু এসবই গুঢ় মনোজগতের ব্যাপার। তুশ্চু মানবশিশু ধরতাই পাবে না।
কুছ কুছ কাভি নেহি হোতা হ্যায়-
তা এই আ-ডল-এসেন্স সময়ে ভারতভূমির পাড়াঘর কাঁপিয়ে হঠাৎ কালবৈশাখীর মত হাঁইহাঁই এসে পরলো কুছ কুছ হোতা হ্যায়; আর আমাদের নিরীহ কৈশোর কুচ কুচ কেটে বেলুনজগতে প্রবেশিল হৃদয়াকার টকটকে লাল এক বেলুন, যা না পারি মাবাবা’র কাছে চাইতে না পারি ‘ওরে হ্যাট্’ ইগনোর করে পাশ কাটাতে। একেই বেলুনবিদ্রোহ আমাদের পরিবারে জন্মাবধি কু-জেতে তায় প্রেমসমৃদ্ধ বেলুনবায়না। বেলুনের হাওয়া আর আমার পিঠের ছাল একসাথে বেড়িয়ে যাবে। এহেন আমার তৃতীয় ক্রাশ যে কিনা একবছরের মধ্যে আমায় রাস্তায় পাকড়িয়ে প্রপোজ করতে চলেছিল, উক্ত চরকের মেলায় এক বিদঘুটে কাজ করে বসল। বোধকরি পাঁচ টাকা জমিয়ে কিনে ফেলল সেই বিষম বস্তুটি। আর তার আদিখ্যেতা দেখে কে! তেনাদের ছাদে উঠে সে মহাখচ্চর প্যান্টের পিছনে হৃদয়ের সুতো আটকে একঘন্টা আমায় দেখিয়ে দেখিয়ে পায়চারি করল। তা সেই লাঙ্গুললেজপরিক্রমণ হজম করে সন্ধ্যেবেলা নীচে নেমে দেখি আমার জ্যাঠতুতো এক দিদিও ঐ একই জিনিস কিনে এনে তার ঘর আলো করে রেখেছে। বুকের একপাশে চিনচিনে ব্যাথা, অন্যপাশে ঝিনঝিনে ভয় সামলে মায়ের কাছে আবার একপ্রস্থ বায়না করে ফেললাম। মনে আশা, কাল বিকেলে আমিও লেজ লাগিয়ে ছাদে যাব। যদিও মদীয় ভবনে ও বস্তু এল না। অমল বেলুনওলাদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে আরও চাড্ডি বসন্ত পার করল।
বৃথা চেষ্টা -
ইতিমধ্যে সে প্রেম ঝাড়েবংশে বেড়ে ওঠার আগেই আমি লেজেগোবরে করেছি ও বেচারা প্রেমিকপ্রবর তার বাড়ীতে উত্তম প্যাঁদানি খেয়ে সে বছর ফেল করে মনের দুঃখে পরের বছর অংকে একটি জাঁদরেল নম্বর হাঁকিয়েছে। যদিও আশা ছাড়েনি। কিন্তু সে গল্প থাক। ওখানে বেলুন নেই খুব একটা। মানে থাকলেও অলঙ্কার পদবাচ্য, গোবেচারা বিশেষনমাত্র। অর্থাৎ, তার ফেলের খবর পেয়ে আমার ফ্যান্টাসির বেলুন তৎক্ষণাৎ চুপসে গেছে। ততদিনে বোধহয় আর একটি দুটি নতুন ক্রাশ ও জমা হয়েছে; এবং টাইটানিক ডুবিয়ে লিওনার্দো-প্রেমের ঘোড়া লাগামছেঁড়া দিগবিদিগ দৌড়চ্ছে। আমার একটি মাত্র মামা বিয়ে করেছে ও কোন এক চরকে বনুও জন্মেছে। ও একটু বড় হতে, আমি হাড়হাভাতের মত ওর কাছ থেকে মাঝে মাঝে বেলুন ভিক্ষা করে আনি। আমার পোড়া কপাল, তিনটে আনলে তার মধ্যে দুটো ফুটো বেড়োয়, একটা ফটাস করে ফেটে যায়। কিরে কেটে বলছি, হপ্তা খানেক আগেও আনলাম, সেম ন্যাড়া সেম বেলতলা। কানা মামার মত ফাটা বেলুনে আঙুল পুরে হাওয়া ভরে প্যাঁট করে ফোলাই, হাতের তেলোয় প্যাঁকপ্যাঁক করে আওয়াজ করি, তারপর প্যাঁচ মারতে মারতে ফটাস করে ফাটিয়ে ফেলি; আর মা কোত্থেকে একটা খেঁকিয়ে “উফ্” করে ওঠে…
শেষাবধি মোক্ষলাভ -
যখন অনেক বড় হয়ে গেলাম, কিন্তু মনটা শিশুই রয়ে গেল, চাকরি বাকরি করতে ঝাড়খন্ডের জঙ্গলে দাপিয়ে দৌরাত্ম করে চলেছি; এমতবস্থায় একদিন বাড়ি ফিরে শুনি পানিহাটি মেলা চলছে। আমার সাথে মা আর মার সাথে আমি একদিন বিকেলে হানা দিলাম। গয়নাগাঁটি, জামাকাপড় কিছুরই তেমন বায়না নেই আমার; এদিকে মা দেদার কিনে চলেছে। শেষমেশ যখন দেখল আমি কিছুই কিনছি না, একটা ছোটখাটো মেলোড্রামা বাধবে বাধবে, সেই সুযোগে আমি তিনটে বর চাইলাম; একটা বেলুন, একটা গোল বেলুন, একটা গোল গ্যাস বেলুন... প্রশ্ন উঠতেই পারে, এত দিনেও নিজে একটা কিনি নি কেন! সদুত্তর নেই। কিন্তু মন বলে, বেলুন কেউ কিনে দিলে যতটা ভালো লাগে, নিজে নিজে কেনায় সেই ভালোলাগা নেই। না কিনলেও ফোলাতে গিয়েই টের পেয়েছি। যাই হোক, সেই সময় তক্ষক মুনি ব্যোমপথে বইছিলেন, একটা তথাস্তু ও আমার হাতে একটা ইয়া বড় নীল গ্যাস বেলুন এসে পড়লো। উইত্তারা, সেই থেকে নীল রঙ হল ভীষন প্রিয়! অ্যাডেনয়েড হিঙ্কলের মত নাচতে না পারলেও ফিলটা কোন অংশে কম ছিল না। বাড়ি ফিরে সে বেলুন খাটের বাটামে টানা চার দিন লটকে রেখেছিলাম। তারপর সেও চুপসে গেল।
ঘুরে ফিরে সেই একই কথা -
এবারের পুজোর ঘটনা। মনে বেলুনপ্রীতি আজও টনটনে। দশমীর দিন বেরোলাম ছবি তুলতে। মা, বাবা, প্রতিবেশী এক পরিবার কলকাতায় ঠাকুর দেখবে ফাঁকায় ফাঁকায় দিনের বেলা। কোন এক কোনা আটকে এক বেলুনওলা মিয়ানো বিড়িতে সুখটান দিচ্ছে। ছবি না তুলে হাঁ করে তাকিয়ে আছি। মা আগে বলত “চল”,এখন বললো “চলতে থাক”; ভালো মানুষের বেটি ঐ ন্যাতানো বিড়ির ধোঁয়ার মত একবুক নিঃশ্বাস ছেড়ে ক্যামেরা বাগিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে এলাম...
পুনশ্চ -
বাড়ি ফিরে আয়নায় চোখ আটকে গেল। শালা পিন ফুটিয়ে বলল, “তুই নিজেই এখন একটা আস্ত বেলুন রে, হতভাগা…”
No comments:
Post a Comment